স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কর্ণার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের ৫০ বছর পূর্তি

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে লোকসাহিত্যের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেটা কোথায় তা নিয়ে ভাবার ব্যাপার আছে। লোকসাহিত্যের (folklore) মধ্যেও একটা সমাজজীবনের আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ চিত্র পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ বলেই অনেক কথা বলার আছে।

রুশ লোককলাবিদ ওয়াই.এম.সকোলভ লোককলার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: ‘Folklore is an echo of the Past and at the same time it is the vigorous voice of the Present. অর্থাৎ ‘লোককলা অতীতের প্রতিধ্বনি এবং একই সঙ্গে বর্তমানের বলিষ্ঠ কণ্ঠসর।’ আজকের বর্তমান এই স্বাধীন বাংলাদেশের যে নৃশংস-যন্ত্রণাদায়ক- গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী অতীত ইতিহাস আছে তা বর্তমান প্রজন্মকে প্রতি পদক্ষেপে স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত নয় কি?

আমার মনে হয় নতুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের সাহসী যুদ্ধের ইতিহাস জানা অতীব জরুরি। নতুবা দেশ যে কোনো সময় বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হলে নতুন প্রজন্ম দেশবাঁচানো তো দূরে থাক, ঘর থেকে বাইরে বের হবে কিনা সন্দেহ। আশাকরি, এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয় অনেকটা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে কেন আমি লোককলা তথা লোকসাহিত্য বিষয়টা আলোচনা প্রসঙ্গে টানলাম?
২. ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি অঞ্চল (পশ্চিম পাকিস্তান যা বর্তমানে পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান যা বর্তমানে বাংলাদেশ) গঠিত হলো এবং দু’ ভ‚খণ্ডের ধর্ম ব্যতীত তাঁদের ভাষা- সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি আলাদা থাকা সত্ত্বেও আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো উর্দু ভাষা। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে দিতে হলো রক্ত।

বাঙালিরা ভীরু-কাপুরুষ নয়; রক্ত দিয়ে বিদেশি শকুনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলো মাতৃভাষাকে। তাই বোধ করি ‘বাংলা’ শুধু মাত্র দুই অক্ষরের একটা শব্দ নয়। এটি পুরো বাঙালি জাতির অস্থিস্বরূপ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বারবার বাংলা শব্দকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছে কিন্তু বাঙালি জাতি দুর্বার। তাই ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :

বাঙালি জাতিকে বারবার মেধাশূন্য করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু যে জাতি দুর্দমনীয় তাঁদেরকে ধ্বংস করার চেষ্টা নিছক বোকামি। ছাত্ররা ১৯৬২ তে এসে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ‘শিক্ষা সংকোচন নীতি’ পরিহার করে।

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। এ সময়ে তিনি বলেন, ‘একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।…জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি-আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’। (তথ্যসংগ্রহ: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পরিচয় (১৯৫৫-১৯৭৫), পৃ:২৯৭)। অথচ সমাজের অনেকের মধ্যে বিশেষত গ্রাম্য এলাকায় অনেকেই ‘বাংলাদেশ’ মুখে আনতে লজ্জা বোধ করে। মার্কেটে কেনাকাটা করতে করে গেলে তাদের প্রথমে দোকানিকে জিজ্ঞেস করতে হয়, ‘ভাই এটা ইন্ডিয়ান তো? ইন্ডিয়ান হলে নিব। তা না হলে নেব না।’

সে সময়ে ক্রেতাকে ‘বিদেশি পণ্য বর্জন’ করে ‘দেশীয় পণ্যতে’ উদ্বুদ্ধ করানোটা কি জরুরি নয়? দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের সকলের দেশের সংগ্রামী ইতিহাস জানা উচিত বলে মনে করি। যেমন অনেক বিজ্ঞ-জ্ঞানীরা বলেন, ছেলেমেয়ে যদি বাবা-মায়ের পরিশ্রমটা নিজ চোখে দেখে, উপলব্ধি করে তাহলে ছেলেমেয়ে উচ্ছৃৃঙ্খল না হয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে এই ভেবে যে- তার বাবা-মা তাঁর জন্য পরিশ্রম করছে। তাকে তার মূল্য দিতে হবে। তাই বোধ করি সমাজের সকল শ্রেণির দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা অতীব জরুরি। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করার পরেও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো নানা ধরনের ক‚টনৈতিক চাল চালতে থাকে। শেষমেশ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভুট্টোর কূটনৈতিক চাল বুঝতে পেরে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এবং স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। ’ সেদিন এই আন্দোলিত বক্তব্যে বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো তাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। ইতিহাস- লোক-সাহিত্য-লোক-আন্দোলন যেমন অতীতের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না তেমনি ভবিষ্যতের জনগণকে দেশপ্রেম চেতনায় উজ্জীবিত করতে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে। তাই আমরা আজো যে কোনো স্বদেশবিরোধী আন্দোলনে ৫২’র কথা বলি, মুক্তির কথা বলি, স্বদেশের কথা বলি। কিন্তু শেষমেশ গিরগিটির ন্যায় ছদ্মবেশ ধরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নরপশুগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড, বোমা, গুলিসহ হাজির হলো পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে। এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বললেন :

‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’

৩. শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে রচিত হলো বাংলাদেশ অর্জনের এক সংগ্রামী ইতিহাস। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যেম ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে ‘বাংলাদেশ’-এর নাম স্থান করে নিল। তারপর আমরা বিজিত হয়ে ঘরে ফিরলাম। আমাদের কারো কারো মায়েরা থালাভর্তি ভাত নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আমরা লাল-সবুজের পতাকা হয়ে আকাশে উড়াল দিয়ে মাকে জানান দিলাম ‘মা, আমার জন্য রাখা তোমার থালার ভাত জমিতে ছিটিয়ে দাও।’

আমরা বিজয়ের গান গাই। একটি প্রসঙ্গ টেনে আমি ইতি টানতে চাই যে, রোকেয়া সাখাওয়াত বাঙালিদের আঁতে ঘা লাগাতে নানা ব্যঙ্গাত্মক উক্তি করেছিলেন বটে তবে তা শুধুমাত্র বাঙালিদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে কিংবা সমাজ তথা দেশের উন্নতির জন্য। আমি এ কথা অস্বীকার করতে পারি না যে, বাঙালি জাতি বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর পদঘাতে পিষ্ট হলেও কখনো কারোর পদতলে আশ্রয় নেয়নি; কখনো কোনো বিদেশির অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করেনি; তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে চিরকাল।

সে মোগল সাম্রাজ্যই হোক কিংবা পলাশীর প্রান্তরেই হোক, কিংবা ৪৭ পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনামলেই হোক। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ গ্রন্থে বাঙালিদেও (বঙ্গীয় জনসাধারণ) প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছন যে, ‘বর্তমান বাঙালি জনসাধারণ তাঁহাদের বংশধর- যাঁহাদের দুর্দান্ত সাহসিকতা ও রণ-নৈপুণ্য দেখিয়া ইতিহাস-পূর্ব যুগে প্রসিদ্ধ রোমক কবি ভার্জিল লিখিয়াছিলেন-‘গঙ্গারাঢ়ীদের আশ্চর্য রণনৈপুণ্যের কথা বিজয় স্তম্ভে গজদন্তের ওপর স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া রাখা উচিত।’

এক্ষণে কি বলতে পারি না যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল ছেলেরা তাঁদের নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে লাল-সবুজের পতাকা এঁকে যে সাহসিকতার পরিচয় দিলেন তা ‘গজদন্তের ওপর স্বর্ণাক্ষরে লেখার ন্যায়’ বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা সারাদেশের প্রতিটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হোক! বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত হওয়া উচিত যার গুরুত্ব আমি আমার ভবিষ্যতব্য গবেষণা কাজের জন্য তথ্য সংগ্রহ করার সময় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্ম (বাচ্চারা) মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনাবগত। আমাদের উচিত নয় কি বাচ্চাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে? আমি বোধ করি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়ক একটা পাঠ্যবই প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা গেলে আমাদের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দ্রুত প্রজ্বালিত হয়ে উঠত। পক্ষান্তরে এদেশীয় রাজাকারদের সমূলে উৎপাটন না করা হলে দেশের মঙ্গল নেই। বোধ করি দেশের আনাচে-কানাচে আজো দেশবিরোধী রাজাকাররূপী জনগণ মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মুখোশ টেনে না খুলতে পারলে বিজয়ের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে পাব না।

লেখক: শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়



স্বাধীনতার ঘোষণা

ইয়াহিয়া খান ২৭ মার্চ পাকিস্তান রেডিওতে এক ঘোষণায় সামরিক আইন জারি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিব ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়। মূল ঘোষণার অনুবাদ নিম্নরূপ: “এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক। জয় বাংলা।” এর কিছুক্ষণ পর তিনি বাংলায় একটি ঘোষণা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন– “সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপােষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রু বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক লােকদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা। টেক্সাসে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নথি সংগ্রাহক মাহবুবুর রহমান জালাল বলেন, “বিভিন্ন সূত্র ও দলিল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এটিই প্রমাণিত হয় যে, ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যা ছিল তার বা অন্য কারো হয়ে ঘোষণা দেওয়ার অনেক পূর্বে। স্বাধীনতা ঘোষণার পরই রাত ১টা ৩০ মিনিটের সময় শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর একটি দল তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ও সামরিক জিপে তুলে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ রাতে তাকে আটক রাখা হয় আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে। পরদিন তাকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করে করাচিতে প্রেরণ করা হয়। করাচি বিমানবন্দরে পেছনে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার সামনের আসনে বসা অবস্থায় শেখ মুজিবের ছবি পরদিন প্রায় সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। এর আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে শেখ মুজিবকে ক্ষমতালোলুপ দেশপ্রেমবর্জিত লোক আখ্যা দিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত হানা এবং ১২ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অভিযোগ তোলেন ও বলেন যে এই অপরাধের শাস্তি তাকে (শেখ মুজিবকে) পেতেই হবে।



কারামুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়বরণ করার ফলশ্রুতিতে ২০শে ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাচ্যুত হলে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকালেও ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ভুট্টো নিজের স্বার্থ, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পরিণতি ও আন্তর্জাতিক চাপের কথা চিন্তা করে শেখ মুজিবের কোন ক্ষতি করতে চাননি। শেখ মুজিবের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোন স্থানে সরিয়ে ফেলতে চান এবং মিঁয়াওয়ালী কারাগারের প্রধান হাবিব আলীকে সেরূপ আদেশ দিয়ে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন। ২২শে ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানকে মিঁয়াওয়ালী কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং একটি অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। এরপর ২৬শে ডিসেম্বর সিহালার পুলিশ রেস্ট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। ভুট্টো ঐদিন সেখানে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন। ডিসেম্বরের শেষের দিকে (২৯ অথবা ৩০ ডিসেম্বর) পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদের সাথে এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে আবার ভুট্টোর সাথে মুজিবের বৈঠক হয়। ভুট্টো তাকে পশ্চিম পাকিস্তান ও নবগঠিত বাংলাদেশের সাথে ন্যূনতম কোন “লুস কানেকশন” রাখার অর্থাৎ শিথিল কনফেডারেশন গঠন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু শেখ মুজিব ঢাকায় এসে জনগণের মতামত না জেনে কোন প্রকার প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকার করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারি ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তান ত্যাগের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। সেদিন রাত ২টায় অর্থাৎ ৮ই জানুয়ারির প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি কার্গো বিমান লন্ডনের উদ্দেশ্যে রাওয়ালপিন্ডি ছাড়ে। ভুট্টো নিজে বিমানবন্দরে এসে শেখ মুজিবকে বিদায় জানান। লন্ডনে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি লন্ডন থেকে নয়াদিল্লিতে ফিরে আসেন এবং ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের পর জনসমক্ষে ইন্দিরা গান্ধী ও “ভারতের জনগণ আমার জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু” বলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে এসে তিনি সেদিন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সামনে বক্তৃতা দেন।



বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা ডাকতেন খোকা বলে। খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গি-পাড়ায়। ৭ বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। নয় বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে তিনি স্থানীয় মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৪ বছর বয়সে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে তার একটি চোখ কলকাতায় অপারেশন করা হয় এবং চক্ষুরোগের কারণে তার লেখাপড়ার সাময়িক বিরতি ঘটে। চক্ষুরোগে চার বছর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার পর শেখ মুজিব পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন। ১৮ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হয়। তারা দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল এর জনক-জননী। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে এলে বঙ্গবন্ধু স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ত তা সারাবার জন্য ও ছাত্রাবাসের দাবি স্কুল ছাত্রদের পক্ষ থেকে তুলে ধরেন। শেখ মুজিব নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাকে গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়।



ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এর ভাষণ

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি উক্ত ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। উক্ত ভাষণ ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়। এই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য অচিরেই বিতরণ করা হয়েছিল। এটি তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক কিছু পরিমার্জিত হয়েছিল। পরিমার্জনার মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। ১৩টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। ১৩ তম হিসাবে মাহাতো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর কুড়মালি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়, যা নৃ তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় ১ম অনুবাদ।নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।



স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্জনের বাংলাদেশ

ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের নিকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, প্রায় সর্বক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যজাত জাতির ৪৩ বছরের অর্জনের পরিসংখ্যানও নিতান্ত অপ্রতুল নয়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেবার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।



বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

বাংলাদেশের প্রথম ভূস্থির যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ। এটি ২০১৮ সালের ১১ মে (বাংলাদেশ সময় ১২ মে) কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়।[৩] এর মধ্য দিয়ে ৫৭ তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যোগ হয় বাংলাদেশ। এই প্রকল্পটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক বাস্তবায়িত হয় এবং এটি ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ রকেটের প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ ছিল।



স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষাখাতে অর্জন

শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো- শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেবার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা। বর্তমান ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে “শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে “শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট”।